অনলাইনে বাড়ছে নজরদারি, থাকছে আড়ি পাতার সুযোগ

শুধু টেলিফোন বা মোবাইল অপারেটর নয়, এখন থেকে ইন্টারনেটভিত্তিক সব সেবা সরকারের নিয়ন্ত্রণের আওতায় আসবে। ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা নেটফ্লিক্সের মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলোও বাংলাদেশে সেবা দিতে চাইলে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। শর্তসাপেক্ষে আড়িপাতা যাবে। এমন বিধান রেখে সরকার ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়া করেছে। এ নিয়ে অংশীজনের মতামত চেয়েছে। এই আইন কার্যকর হলে বাতিল হয়ে যাবে ঔপনিবেশিক যুগের টেলিগ্রাফ আইন ১৮৮৫ ও ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি আইন ১৯৩৩।

টেলিযোগাযোগ বিভাগের একজন যুগ্ম সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইন ছিল মূলত মোবাইল অপারেটরদের লাইসেন্স, সেবা ও তদারকি কাঠামো নির্ধারণে সীমাবদ্ধ। সেই সময় মোবাইল ফোন ছিল বিলাসিতা, ইন্টারনেটও ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে। কিন্তু দুই দশকে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে গেছে। এখন মানুষ কেবল ফোনে কথা বলে না– সামাজিক মাধ্যম, ভিডিও প্ল্যাটফর্ম ও বার্তা বিনিময় অ্যাপের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যমান আইন দিয়ে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তদারকি সম্ভব নয়। তাই নতুন আইন আনতে হচ্ছে, যেখানে টেলিযোগাযোগের পাশাপাশি ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম, ওভার দ্য টপ (ওটিটি) সেবা, ভিডিও স্ট্রিমিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি)– সবই তদারকি করা যাবে।

সামাজিক মাধ্যমের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক
খসড়া আইনে প্রথমবারের মতো উল্লেখ করা হয়েছে– যে কোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম (যেমন– ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, নেটফ্লিক্স বা টিকটক) যদি বাংলাদেশে সেবা দেয়, তবে তাদের সরকারের অনুমোদন ও নিবন্ধন নিতে হবে। প্রয়োজনে নিরাপত্তা সংস্থাকে তথ্য দিতে হবে এবং ব্যবহারকারীর তথ্য সংরক্ষণে সরকারের নির্দেশনা মানতে হবে। অর্থাৎ, বিদেশি ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোও এখন থেকে বাংলাদেশের আইনি কাঠামোর মধ্যে আসবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একদিকে রাষ্ট্রের জন্য দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নতুন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। গোপনীয়তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এ বিষয়ে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, নজরদারি জরুরি, কিন্তু নিয়ন্ত্রণে পরিণত হওয়া বিপজ্জনক। আইনটি যেন স্বাধীনতার পরিসর সংকুচিত না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, খসড়ায় নাগরিকের তথ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা নেই। অথচ তথ্যই এখন ক্ষমতার উৎস। তাই নিরাপত্তার সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ভারসাম্য না থাকলে এটি হবে নজরদারি রাষ্ট্রের আইন। তিনি আরও বলেন, আইনটিতে আরও অনেক অস্পষ্টতা রয়েছে। অনলাইন প্লাটফর্মগুলোকে নিবন্ধন পেতে কী কী শর্ত মানতে হবে, ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার কী পদক্ষেপ থাকবে– এ বিষয়গুলো স্পষ্ট উল্লেখ নেই।

সুমন আহমেদ সাবির মনে করেন, নতুন আইনটি সময়োপযোগী হলেও এর প্রয়োগ কাঠামোতে ভারসাম্য থাকা জরুরি।

শর্তসাপেক্ষ আড়িপাতা
নতুন খসড়ায় আদালতের অনুমোদন ও নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে আড়িপাতা বা যোগাযোগে নজরদারির বিধান রাখা হয়েছে। খসড়ার ধারা ৯৭ ও ৯৭(খ) অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা বা অপরাধ তদন্তের প্রয়োজনে আদালত বা অনুমোদিত কাউন্সিলের নির্দেশে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যোগাযোগ, বার্তা বা ট্রাফিক তথ্য সংগ্রহ করা যাবে। এ কার্যক্রমের জন্য গঠন করা হবে কেন্দ্রীয় আইনানুগ ইন্টারসেপশন প্ল্যাটফর্ম (সিএলআইপি), যা পরিচালিত হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে।

খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, ‘এই ধারার আওতায় গঠিত কাঠামো কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বের আড়িপাতা-সংক্রান্ত কাঠামো বাতিল গণ্য হবে।’ অর্থাৎ, বিদ্যমান ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) কার্যক্রম নতুন সিএলআইপি প্ল্যাটফর্মে প্রতিস্থাপিত হবে।

নতুন কমিশন, তবে ক্ষমতাহীন
বর্তমান ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে’র (বিটিআরসি) পরিবর্তে গঠন করা হবে নতুন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কমিশন। এটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে ঘোষিত হবে। কমিশন হবে পাঁচ সদস্যের– একজন করে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান এবং তিনজন সদস্য।

একই খসড়ার বিভিন্ন ধারায় দেখা যায়, কমিশনের ক্ষমতা কমিয়ে আনা হয়েছে এবং তা সরকারের নীতিনির্ধারণী দিকনির্দেশনার ওপর নির্ভরশীল করা হয়েছে। ২০০১ সালের আইনে বিটিআরসি ছিল স্বশাসিত ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এটা লাইসেন্স দেওয়া, স্পেকট্রাম ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণ, তদন্ত, এমনকি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রাখত।

নতুন খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘কমিশন তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের নীতি ও দিকনির্দেশনা অনুসরণ করবে।’ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ লাইসেন্স দেওয়া ও বাতিলের জন্য পাঁচজন মন্ত্রীর সমন্বয়ে কমিটি কাজ করবে। এ ছাড়া কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ১১ সদস্যের ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কমিটি’ গঠন করা হবে। বড় ধরনের ট্যারিফ, লাইসেন্স-সংক্রান্ত বিষয়ে এই কমিটি আলোচনা করবে। বড় ট্যারিফ নির্ধারণের আগেই সরকারের অনুমতি নিতে হবে। ফলে কমিশনের স্বাধীনতা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। বিটিআরসির এক সাবেক কমিশনারের ভাষায়, ‘নাম পাল্টে স্বাধীনতা বাড়ানো যাবে না, যদি নীতিগত ক্ষমতা সরকারের হাতেই থাকে।’

প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা বলছেন, নিবন্ধন ও অনুমোদনের প্রক্রিয়া অতিরিক্ত জটিল হলে নতুন উদ্যোগ বা স্টার্টআপ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। প্রযুক্তি উদ্যোক্তা মুস্তাকীম বিল্লাহ বলেন, লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া যত জটিল হবে  উদ্ভাবনের গতি তত ধীর হবে।

News Source

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *